মৌলভীবাজারে চিকিৎসা খাতে একক আধিপত্য জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ডা. সাব্বির হোসেন খানের। মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতালের সিন্ডিকেটের মূলহোতা তিনি। তার কথার বাইরে মৌলভীবাজার সদর কিংবা উপজেলার অন্যান্য হাসপাতালের ডাক্তার, কর্মকর্তা-কর্মচারী, নার্স গেলেই শুরু হতো অপদস্থ, বদলি ও নির্যাতন।
মৌলভীবাজারে চিকিৎসা খাতে একক আধিপত্য আ.লীগ নেতা ডা. সাব্বিরের
তার রোষানলে পড়ে অনেকেই মৌলভীবাজারে চাকরি করতে পারেননি, হয়েছেন স্থানান্তর। জেলার প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে নানাভাবে তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। তার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ল্যাবটেস্ট করার জন্য রোগী পাঠাতে বাধ্য করতেন ডাক্তারদের।
অন্যান্য জেলার তুলনায় মৌলভীবাজারে ল্যাব টেস্ট ও অপারেশনের অতিরিক্ত ফি নির্ধারণ করে দিতেন। অভিযোগের শেষ নেই জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ডা. সাব্বির হোসেন খানের বিরুদ্ধে।অভিযোগ উঠেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ডাকা বিক্ষোভে আহত শিক্ষার্থীদের তিনি চিকিৎসা না দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন সরকারি হাসপাতাল সহ প্রাইভেট হাসপাতালে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ করে ডা. সাব্বির খান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার নিজের আইডি থেকে একটি পোস্ট শেয়ার করে বলেন, ২৯টারে বিদায় করছি, লাল কার্ড দেখাইয়া। ভুল বোঝার কিছু নাই, রাজাকার মুক্ত করছি। তার এই পোস্টের স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। উঠে নিন্দার ঝড়। যদিও সরকার পতনের পরে এই পোস্টটি তিনি সরিয়ে নেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও জনতার সাথে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অঙ্গ সংগঠনের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে আহত শিক্ষার্থীরা মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে শিক্ষার্থীদের সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। অনেকের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সিলেটসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। সূত্র বলছে, বিএমএর সাবেক সভাপতি ডা. সাব্বির হোসেন খানের নির্দেশে চিকিৎসক, নার্সরা আহতদের চিকিৎসা দেননি।
আহত শিক্ষার্থী ইমাদ উদ্দিন আহমদ বলেন, হাসপাতালে যাবার পর একজন এসে বলেন তুমি কি আকাম করেছ? আমি বলি কোন আকাম করিনি। আমি আন্দোলনে ছিলাম। আমার শরীরে আঘাত করা হয়েছে। একথা বলতেই তারা এমনভাবে রিয়েক্ট করে যে আমি বড় কোনো অন্যায় করে এসেছি। তারা আমার ট্রিটমেন্ট করেনি।
আমাকে ঘুমের স্যালাইন ও ইনজেকশন দেয় যাতে আমি ঘুমিয়ে যাই। এরপর রাত ১১টার দিকে ডা. পিয়াস হাসান আমাকে কিছু টেস্ট দেন। টেস্টের পর ডাক্তার আমাকে তাড়াতাড়ি সিলেট নিতে বলেন। আহত শিক্ষার্থী আফজাল হোসাইন মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ করেন।
সরেজমিন মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল রোডে ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে কাছে গেলে দেখা যায়, ৭তলা ফাউন্ডেশনের একটি নতুন ভবনের কাজ চলছে। এখানে হাসপাতালের জন্য প্রায় ৩ কোটি টাকা দিয়ে জায়গা ক্রয় করেছেন ডা. সাব্বির হোসেন খানের নেতৃত্বাধীন একটি গ্রুপ।
সেখানে কাজের দায়িত্বে থাকা শাহিন বলেন, হাসপাতালের মূল মালিক ডা. সাব্বির স্যার। হাসপাতালের শেয়ারে ২৬-২৭ জন রয়েছেন। ওসি প্রতিদিন এখানে আসতেন। সবকিছু দেখাশুনা করতেন। বর্তমানে উনি না থাকায় কাজ বন্ধ রয়েছে।
ডা. সাব্বিরের মামলার শিকার মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সাংবাদিক আজাদুর রহমান বলেন, ২০০৮ সালে ডা. সাব্বির হোসেন খানের মালিকানাধীন ইউনাইটেড কমপ্যাথ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একজন যুক্তরাজ্য প্রবাসী মহিলা ডায়াবেটিসসহ কয়েকটি টেস্ট করান। সেই রিপোর্ট সিলেটসহ বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভুল প্রমাণিত হয়।
সেই ভুল রিপোর্টের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন করি। এই প্রতিবেদন প্রকাশ হলে ৫ কোটি টাকার মিথ্যা মানহানি মামলা করেন ডা. সাব্বির খান। সেই মামলাটি ২০১৮ সালে যুগ্ম জেলা জজ আদালত খারিজ করেন। ওই চিকিৎসক আবার ২০২১ সালে আপিল করেন। আপিল মামলাটি এখনো চলমান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের সিনিয়র কয়েকজন নার্স বলেন, হাসপাতালে ডা. সাব্বির খানের একক আধিপত্য ছিল। তিনি যাই বলতেন তাই করতে হতো। তার কথার বাইরে যাবার সাধ্য কারও ছিল না। হাসপাতালের কেই না হয়েও তিনি হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং তার পছন্দের কয়েকজন ব্যক্তিকে বিশেষ সুবিধা দিতেন। আমরা অসহায় ছিলাম।
মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের একজন গাইনি চিকিৎসক জানান, বিগত ১৫ বছরে আমার কোনো প্রমোশন হয়নি। তিনি আমাকে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করেছেন। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন আমি নিয়মিত ডিউটি করিনি। মূলত ওনাকে সেলামি না দিলে বিভিন্ন অভিযোগ তুলেন।
ডা. ইফতেখার হোসেন মোহন নামের একজন চিকিৎসক জানান, সাব্বির খান ওনার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আমাকে নিয়ে হুমকি দিয়েছেন। তুমি আগে আমার সঙ্গে কেন দেখা করনি। স্যার প্রয়োজন হয়নি, এজন্য আসিনি। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, আগামীতে প্রয়োজন হবে। এ বিষয়টি মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের কয়েকজন ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করলে উনারা বলেন, ওনাকে মাঝেমধ্যে কিছু গিফট দিবা। আমি স্বাচিপের সদস্য না হওয়ায় ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন।
মৌলভীবাজার বিএমএ সদস্য একজন চিকিৎসক বলেন, কোনো চিকিৎসক উনার কথা মতো না চললে নানাভাবে হেনস্তা করতেন। তার অনুসারী গুটিকয়েক চিকিৎসক নিয়ে উনি সিন্ডিকেট করেছেন। রোগীকে প্রভাবিত করে তার অনুগতের বাহিরের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মামলা হামলার ভয় দেখাতেন।
মৌলভীবাজার পৌর শহরের বেরিরপার এলাকার সাইফুল ইসলাম সোহেল নামে একজন ভুক্তভোগী বলেন, মৌলভীবাজারের চিকিৎসকদের রাজা ছিলেন ডা. সাব্বির হোসেন খান। এ জেলার চিকিৎসা সেবাকে তিনি ধ্বংস করেছেন। উনার মালিকানাধীন ইউনাইটেড কমপ্যাথ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্টে ভুল আসে।
শহরের অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষিকা বলেন, ডা. সাব্বির দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ২০১৮ সালে উনার স্ত্রী ডা. জেবীন চৌধুরীসহ তাদের সিন্ডিকেট দিয়ে মৌলভীবাজার মহিলা সমিতির একটি কমিটি করেন। এখন পর্যন্ত অবৈধ কমিটি রয়েছে। কমিটির কয়েকজন ডা. সদস্য উনার স্ত্রীকে সমর্থন না করায় পেশাগতভাবে তাদের হয়রানি করেন।
এসব বিষয়ে জানতে মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ডা. সাব্বির হোসেন খানের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করলে বন্ধ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে উনার ইউনাইটেড কমপ্যাথ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
আরও দেখুনঃ