৪০ পরিবারের পানির ভরসা মোল্লাবাড়ি,সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গিয়াসনগর ইউনিয়নের ভুজবল মোল্লাবাড়িতে কলস নিয়ে এক-দুজন করে নারী-পুরুষ আসছেন। কলসে পানি ভরে পুরুষ ও নারীরা বাড়ি ফিরছিলেন। প্রতিদিন এই বাড়ি থেকে খাওয়ার ও রান্নাবান্নার জন্য পানি সংগ্রহ করে অন্তত ৪০টি পরিবার। শুষ্ক মৌসুমে ভুজবল গ্রামের নলকূপে পানি ওঠে না। এতে পানি–সংকটে পড়েন অনেকেই। এসব পরিবারের জন্য মোল্লাবাড়িতে পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

৪০ পরিবারের পানির ভরসা মোল্লাবাড়ি
গত শুক্রবার বিকেলে ভুজবল মোল্লাবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পানি সংগ্রহ করতে নারী-পুরুষ কলস নিয়ে আসছেন। পাকা দালানের দক্ষিণ দিকে পানির ট্যাপ। গ্রিলের ভেতর বিদ্যুতের সুইচ। সেই সুইচ বাঁশের লাঠি দিয়ে চালু করে নারী–পুরুষেরা পানি সংগ্রহ করছেন। ঘণ্টাখানেক বাড়িটিতে অবস্থানের সময় ১০–১৫ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে কলস এবং বালতিতে পানি নিয়ে যেতে দেখা যায়।
এ রকমই একজন কৃষ্ণ মালাকার দুটি খালি কলস নিয়ে আসেন। ট্যাপের নিচে কলস রেখে বাঁশের লাঠি নিয়ে সুইচে চাপ দেন, কিন্তু তখন বিদ্যুৎ ছিল না। বিদ্যুতের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাড়ির লোকজনের ব্যবহারের সংরক্ষিত চৌবাচ্চার পানিতে কলস ভরে নেন। এই নিয়ম অবশ্য সবার জন্যই। বিদ্যুৎ থাকলে সরাসরি সুইচ চালু করে পানি নেন, না হলে বাড়ির সংরক্ষিত পানি নিতে পারেন সবাই।
কৃষ্ণ মালাকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিপকলে (নলকূপে) পৌষ থাকি চৈত্র মাস পর্যন্ত পানি মিলে না। এবার বৃষ্টি নাই, বৈশাখেও পানি পাইরাম (পাচ্ছি) না। আমরার দুর্ভাগ্য কল দিয়াও পানি নাই।’ তিনি (কৃষ্ণ মালাকার) বলেন, ‘আমরার পানির কষ্ট দেখি তাইন কইন (বাড়ির মালিক আবদুল বাছিত বাচ্চু) পানি নেও, খাও। আমরা নিজে সুইচ দিই, বন্ধ করি। কারেন্ট না থাকলে বাড়ির ট্যাংকর (চৌবাচ্চা) পানি নেই।

কিতা করমু, পুকুরও পানি নাই। রান্না, খাওয়ার জন্য দিনে দুইবার পানি নেওয়া লাগে।’ অনেকটা একই কথা বলেন অন্য বাসিন্দারাও।জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, আশ্বিন-কার্তিক মাস থেকেই ভুজবলে খাওয়ার পানির সংকট দেখা দেয়। নলকূপে পানি ওঠা কমতে থাকে। পৌষ মাস থেকে আর পানি ওঠে না। পুকুরগুলোও শুকিয়ে যায়। যেটুকু পানি থাকে, তা ব্যবহারের উপযোগী নয়। তখন রান্নাবান্না ও খাওয়ার পানির সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। শুধু নীলমনি দাস নামের একজনের নলকূপে পানি ওঠে। কিন্তু সেই পানিতে আয়রনের পরিমাণ
বেশি। পানি তোলার সময় স্বচ্ছ থাকে। কিছু পরই ঘোলা হয়ে যায়। তা–ও কিছু লোক ব্যবহার করেন।জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে গ্রামের পাঁচটি বাড়িতে পাঁচটি গভীর নলকূপ দেওয়া আছে। সেসব বাড়ি থেকেও অনেকে পানি সংগ্রহ করেন। কিন্তু দূরত্ব ও নানা কারণে অনেকে সব বাড়িতে গিয়ে পানি সংগ্রহ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এতে অনেক পরিবার নোংরা, দূষিত পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হন। এই সংকট দেখে ভুজবল মোল্লাবাড়ির আবদুল বাছিত বাচ্চু প্রতিবেশী দুই–চারজনকে তাঁদের বাড়ি থেকে পানি নিতে বলেন। পরে অন্যরাও আসেন।
এখন আশপাশের প্রায় ৪০টি পরিবারের লোকজন চার মাস ধরে এই বাড়ি থেকে পানি নিচ্ছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ের। গত বছরও এই মৌসুমে অনেকে পানি নিয়েছেন।আছমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরার টিপকলে বারিষা (বর্ষা) মাসেও পানি কম ওঠে। তবু কোনোমতে জানও বিতাইয়া (কষ্ট করেও) চলি। এখনতো একবারে নাই। দিনে দুইবার পানি নিই। গরিব মানুষ, না পারিয়া আইছি। পুকুরে কাচরা (নোংরা) পানি। তারা না করলে আর পানি নাই। কিন্তু কোনো সময় তারা বাধাও দেইন (দেন) না। কারেন্ট বিলও চাইন (চান) না।’
একই রকম কথা বলেন বৃষ্টি মালাকার, উর্মি মালাকার, জয়া মালাকার, অর্চনা মালাকার প্রমুখ। ভুজবল জামে মসজিদে প্রায় আট বছর ধরে ইমামের দায়িত্ব পালন করছেন আবদুল মুক্তাদির। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সারা দিনই লোকজন পানি নেয়। তবে বিকেলে বেশি আসে। সবাই গরিব মানুষ। এলাকায় কিছু পুকুর থাকলেও ব্যবহারের উপযোগী নয়।
প্রতিবেশীদের জন্য কোনো স্বার্থ ছাড়াই পানির ব্যবস্থা করেছেন বলে জানালেন মোল্লাবাড়ির মালিক আবদুল বাছিত বাচ্চু। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রথমে এক-দুইজন আসত। অনেকে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। পানির সমস্যা দেখে সবাইকে আসতে বলেছি, সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছি। এলাকায় আরও গভীর নলকূপ থাকলেও এরা অন্য কোনো জায়গায় যেতে চায় না। আমার উদ্দেশ্য হলো যাতে এই গরিব মানুষ পানি পায়। ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই।’
আবদুল বাছিত বাচ্চু বলেন, মানুষের পানির কষ্টের বিষয়টি প্রচার হলে গিয়াসনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের উদ্যোগে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে সম্প্রতি একটি গভীর নলকূপ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের নির্ধারিত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য তাদের কারও নেই। তাই ৭ মে ১০ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা দিয়েছেন জানিয়ে আবদুল বাছিত বাচ্চু বলেন, এই নলকূপ স্থাপনের জন্য জায়গা ও বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থাও তিনি করবেন। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
গিয়াসনগর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোশাররফ টিটু প্রথম আলোকে বলেন, এই সময় পানির স্তর নিচে নেমে যায়। সাধারণ নলকূপ ও মোটরে পানি কম ওঠে। তারপরও চারদিকে সরকারি কল আছে। তবু একটি বাড়িতে সবাই ভিড় করছেন। তিনিও সহযোগিতা করছেন। এই বাড়িতে যাঁরা আসেন, তাঁদের জন্য একটা গভীর নলকূপের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর মৌলভীবাজার সদর উপজেলা কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী স্বপন চাকমা বলেন, নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত পানির স্তর নিচে নেমে যায়। দুই-তিন মাস পানি নিচে থাকে। এটা সব বছরই হয়। বৃষ্টি হলে আগেই পানি উঠে যায়। এবার বৃষ্টি দেরিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ভুজবল গ্রামে পাঁচটি গভীর নলকূপ আছে। এসব নলকূপ থেকে সবাইকে পানি দেওয়ার কথা।

পানি নিতে কেউ আপত্তি করেননি। নানা কারণে যে যেখান থেকে পারছেন পানি নিচ্ছেন। ভুজবল জামে মসজিদের কাছে একটি নলকূপ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এটির চালানও জমা দেওয়া হয়েছে। মাস খানেকের মধ্যে নলকূপ স্থাপন করা হবে।
আরও পড়ুন:
