দুর্নীতির মহা উৎসব – বেকার যুব সমাজকে দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করার চ্যালেঞ্জ নতুন বাংলাদেশের। সে আলোকে কাজ শুরু করেছে অন্তর্ববর্তীকালীন সরকার। কিন্তু মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দুর্নীতিতে ভেঁঙ্গে পড়েছে। বিশেষ করে প্রশিক্ষকরা এ কেন্দ্রকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। চলছে দুর্নীতির মহা উৎসব। প্রশিক্ষক ও কর্মচারীদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অনুসন্ধানে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দুর্নীতির মহা উৎসব
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রশিক্ষণার্থীদের ভাতার টাকা আত্মসাৎ, ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স শিক্ষার্থীদের বিআরটিএ পরীক্ষায় উত্তির্ণ করে দেয়ার নামে, ডোপটেস্ট সিরিয়াল, আইটেস্ট ও মেডিকেল সার্টিফিকেটের কথা বলে টাকা আদায়, রেমিটেন্স যোদ্ধাদের সনদ বিক্রি, ভাড়া পরিশোধ না করে সরকারি বাসায় বসবাস, এএসএসইটি প্রকল্পের কাঁচামালের টাকা আত্মসাৎ, গাড়ির তেল বিক্রি, ব্যক্তিগত কাজে প্রশিক্ষণার্থীদের গাড়ি ব্যবহার ও সময়মতো ক্লাস না করারও অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
দুর্নীতি করে এ প্রতিষ্ঠানের অনেকেই ইতিমধ্যে গাড়ি ও বাড়ির মালিক হয়েছেন। রয়েছে বড় অংকের ব্যাংক ব্যালেন্স। তারা জিরো থেকে হিরো হয়েছেন। এরমধ্যে দীর্ঘদিন যাবত ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স কোর্সে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বেকার প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে অর্থ লোপাট করে নিজেদের আখের ঘুছিয়েছেন কোর্সের ইন্সট্রাক্টর মোহাম্মদ আবু ইউসুফ ইমন, মাজহারুল ইসলাম ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ।
বছরের পর বছর প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে অর্থ আদায় এবং চিকিৎসকের নকল সিল ও ভুয়া বিএমডিসি নম্বর দিয়ে জাল স্বাক্ষর করারও অভিযোগ রয়েছে। জানা যায়, তিন মাস অন্তর অন্তর বছরে চারটি গ্রুপে ৩২০ জন বেকার যুবক-যুবতীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণার্থীরা অভিযোগ করেন ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স কোর্সে নামমাত্র প্রশিক্ষণ করানো হয়। কোর্স ইন্সট্রাক্টরের ফাঁকিবাজি এবং অনিয়মের কারণে প্রকৃত প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। ব্যাহত হচ্ছে সরকারের মহতি উদ্যোগ।
ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স কোর্সের প্রশিক্ষনার্থীদের ‘ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য মেডিকেল সার্টিফিকেট’ ফরম-২ এ দেখা যায় ‘ডা: চন্দ্র শেখর কর, মেডিকেল অফিসার’ এ নাম ও পরিচয়ে একটি সিল রয়েছে। তার নিচে হাতে লেখা রেজিষ্ট্রেশন নং অ-৭৫২৩৪ আর সিলের উপরে একটি স্বাক্ষর। বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে খোঁজ নিয়ে এ রেজিষ্ট্রেশন নম্বর ও চিকিৎসকের কোন অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি। এছাড়া ওই চিকিৎসক ভুয়া ও তার সিল জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন কর্তৃপক্ষ।
প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স কোর্সের প্রশিক্ষণার্থী তৌফিকুল ইসলাম বলেন, মাত্র ৬০ টাকার সরকারি ফি দিয়ে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও ভর্তি স্লিপে ৬০ টাকার জায়গায় নেয়া হয় ১’শ টাকা। লার্ণার ফি বাবদ নেয়া হয় ৮’শ টাকা। অথচ লার্ণার ফি প্রদানের পর আমাদের মুঠোফোনে ৫’শ ২৫ টাকার ক্ষুদেবার্তা আসে।
এছাড়া বিআরটিএ অফিস থেকে ডোপটেস্টের সিরিয়াল আগানো ও আইটেস্টের জন্য ২’শ টাকা করে ৪’শ টাকা। চক্ষু হাসপাতালে আইটেস্ট না করে প্রশিক্ষক নিজেই তৈরি করেন। ক্লাস এবং পরীক্ষার কথা বলে ২’শ টাকা দিয়ে একটি স্পাইরাল বাইন্ডিং বই কিনতে বাধ্য করা হয়।
কোর্সের শেষদিকে বিআরটিএ অফিসের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার কথা বলে ২ হাজার ৫’শ টাকা নেয়া হয়েছে। একই অভিযোগ করেন প্রশিক্ষণার্থী মো. নাইম মিয়া, আনোয়ার হোসেন, হাবিবুর রহমান বিল্লাল, জুনেদ মিয়া, অনিক বর্ধন, চয়ন রবি দাস, আব্দুল ওয়াজুদ ফাহাদ এবং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও কয়েকজন প্রশিক্ষণার্থী।
চলমান ১২ তম ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থী আব্দুস সামাদ বলেন, আমাদের পূর্ববর্তী ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে বিআরটিএ অফিসে দেয়ার কথা বলে ২ হাজার ৫’শ টাকা নেয়া হয়েছে। আমরা ভর্তি হওয়ার পরও ইশারা ইঙ্গিতে ঘুষের টাকা দেয়ার জন্য আমাদের বলা হয়। কিন্তু ৫ আগষ্ট সরকার পতনের পর আর বলা হয়নি।
কোর্স ইন্সট্রাক্টর মোহাম্মদ আবু ইউসুফ ইমন বলেন, “প্রশিক্ষণার্থীদের সুবিধার জন্যই তাদের কাছ থেকে ২’শ টাকা করে নিয়ে কম্পিউটারের দোকান থেকে চিকিৎসকের ভুয়া সিল দিয়ে স্বাক্ষর করে চিকিৎসা সনদ প্রদান করছি। শিক্ষার্থীদের ড্রাইভিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণের জন্য মৌলভীবাজার বিআরটিএ’কে শিক্ষার্থী প্রতি ২ হাজার ৫’শ টাকা দিতে হয়”।
একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ২’শ টাকা সরকারি ফি দিয়ে বিদেশগামীদের তিন দিনের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করলেও অনেক ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ না করিয়েই বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তির পর উপস্থিত দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে সনদ বিক্রি হচ্ছে। এ সিন্ডিকেটের মূলহুতা জাহিদুল ইসলাম, আল আমিন, শোয়াইব ও হান্নান। এ সিন্ডিকেট নিজেরাই বিদেশগামীদের বায়োমেট্টিক হাজিরা দেয়।
স্থানীয়রা যাতে বুঝতে না পারেন এজন্য সিন্ডিকেট অধিকাংশ সময় মৌলভীবাজার ব্যতিত অন্য জেলার বিদেশগামীদের কাছে ৩-৪ হাজার টাকায় সনদ বিক্রি করে। গত ১৩ আগস্ট মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ইস্যুকৃত বড়লেখা উপজেলার প্রবাসগামী আব্দুল জলিলের সনদ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। জানা যায়, আব্দুল জলিল প্রশিক্ষণ না দিয়ে ৩ হাজার টাকায় সনদ কিনেছেন।
ওই প্রবাসগামীর সনদে ভুলক্রমে দেশের নাম সৌদি আরবের জায়গায় কাতার এবং আব্দুল জলিলের ছবির জায়গায় অন্যজনের ছবি লাগানো হয়। পরবর্তীতে ওই ব্যক্তি ফেঞ্চুগঞ্জ টিটিসি থেকে আরেকটি সনদ নেন। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ইস্যুকৃত যুক্তরাজ্যগামী দুইজন প্রবাসীর সনদ ওই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। তারাও প্রশিক্ষণ না দিয়ে সনদ কিনেছেন।
সূত্র বলছে, ভাড়া পরিশোধ না করে সরকারি ভবনে থাকছেন ইলেকট্রিক্যাল ইন্সট্রাক্টর এস এম জাহিদুল ইসলাম, সিভিল ইন্সট্রাক্টর রমজান আলী, মাজহারুল ইসলাম, কম্পিউটার প্রশিক্ষক এমদাদুল হক, ইমরান, হোসেন আলী, সাজু জয়রাম, হাউজ কিপিং নাসরিন, স্কীল্ড ওয়ার্কার শোয়াইব, মো: হান্নান মিয়া ও মো: আল-আমিন। পরিবার নিয়ে থাকেন ইন্সট্রাক্টর মো: আসাদুল ইসলাম। ভাড়া পরিশোধ না করার কথা নিশ্চিত করে অধ্যক্ষ মো. আকতার হোসেন বলেন, “তাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আগামী মাসের মধ্যে পূর্বের ভাড়া সহ পরিশোধ করবে”।
দুর্নীতি করে স্কীল্ড ওয়ার্কার শোয়াইব আখাউড়ার কশবায় ৩তলা বিল্ডিং ও সিভিল ইন্সট্রাক্টর রমজান আলী এক্স করলা গাড়ি কিনেছেন। গাড়িটি মৌলভীবাজা শহরে ভাড়ায় চলে। জাহিদুল ইসলাম প্রায় ২০ লক্ষ টাকা ইবেলিতে ইনভেস্ট করেছিলেন।
সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিদর্শন কিংবা অডিটে আসলে নানা উপটোকন ও গিফট দেন দুর্নীতিবাজ প্রশিক্ষকরা। কয়েক মাস পূর্বে অডিটে আসেন উপপরিচালক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা।
উনি সিলেট বিমানবন্দরে যেতে মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বের হয়ে একটু সামনে আগালে গাড়ি থামিয়ে উঠেন প্রশিক্ষক রমজান আলী, এস এম জাহিদুল ইসলাম, আসাদুল ইসলাম, শোয়াইব ও আল-আমিন। মৌলভীবাজার ইনফিনিটি শোরুম থেকে ওই কর্মকর্তা ও তার পরিবারের সদস্যদের ২০ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের কাপড় কিনে দেন।বিআরটিএ মৌলভীবাজারের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) মু. হাবিবুর রহমান বলেন, “ওরা বাঁচার জন্য আমাদের উপর মিথ্যা অভিযোগ তোলছে”।
মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ মো. আকতার হোসেন বলেন, “আমি যোগদানের পর থেকে এসব অনিয়ম দূরকরার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করছি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও অবগত করেছি। ইতিমধ্যে অনেক প্রদক্ষেপও নিয়েছি। তবে একা আমার পক্ষে দীর্ঘদিনের অনিয়ম বন্ধ করা অনেক কষ্ট হচ্ছে। যেহেতু আপনি বিষয় গুলো অবগত করলেন আগামীতে আরও কঠোর হব”। ওই অধ্যক্ষ ২০২২ সালের ২২ জুন দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
আরও দেখুনঃ